সাহেব ও মোসাহেব

nazrul

সাহেব কহেন, “চমৎকার ! সে চমৎকার !”
মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে !
হুজুরের মতে অমত কার ?”
সাহেব কহেন, “কী চমৎকার,
বলতেই দাও, আহা হা।”
মোসাহেব বলে, “হুজুরের কথা
শুনেই বুঝেছি, বাহাহা বাহাহা বাহাহা!”
সাহেব কহেন, ”কথাটা কি জান ? সেদিন– ?
মোসাহেব বলে, “জানি না আবার ?
ঐ যে, কি বলে, যেদিন–”
সাহেব কহেন, ”যেদিন বিকেলে বৃষ্টিটা ছিল স্বল্প।”
মোসাহেব বলে, “আহা হা, শুনেছ ?
কিবা অপরূপ গল্প !”
সাহেব কহেন ”আরে ম’লো ! আগে
বলতেই দাও গোড়াটা !
মোসাহেব বলে, “আহা-হা গোড়াটা !
হুজুরের গোড়া ! এই, চুপ, চুপ ছোঁড়াটা!”
সাহেব কহেন, ”কি বলছিলাম,
গোলমালে গেল গুলায়ে !”
মোসাহেব বলে, “হুজুরের মাথা ! গুলাতেইহবে !
দিব কি হস্ত বুলায়ে !”
সাহেব কহেন, “শোনো না। সেদিন
সূর্য উঠেছে সকালে !”
মোসাহেব বলে, “সকালে সূর্য ?
আমরা কিন্তু দেখি না কাঁদিলে কোঁকালে!”
সাহেব কহেন, “ভাবিলাম, যাই,
আসি খানিকটা বেড়ায়ে,”
মোসাহেব বলে, “অমন সকাল ! যাবে কোথা বাবা,
হুজুরের চোখ এড়ায়ে !”
সাহেব কহেন, “হ’ল না বেড়ানো,
ঘরেই রহিনু বসিয়া !”
মোসাহেব বলে, “আগেই বলেছি ! হুজুর কি চাষা,’
বেড়াবেন হাল চষিয়া ?”
সাহেব কহেন, “বসিয়া বসিয়া
পড়েছি কখন ঝিমায়ে !”
মোসাহেব বলে, “এই চুপ সব !
হুজুর ঝিমান ! পাখা কর্, ডাক্ নিমাইএ!”
সাহেব কহেন, “ঝিমাইনি, কই
এই ত জেগেই রয়েছি।”
মোসাহেব বলে, “হুজুর জেগেই রয়েছেন, তা
আগেই সবারে কয়েছি !”
সাহেব কহেন, “জাগিয়া দেখিনু, জুটিয়াছে যত
হনুমান আর অপদেব !”
“হুজুরের চোখ, যাবে কোথা বাবা ?”
প্রণমিয়া কয় মোসাহেব।

বিদ্রোহী-্কাজী নজরুল ইসলাম

Kazi_nazrul_islam
বল বীর –
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির !
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া
উঠিয়াছে চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর !
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটিকা দীপ্ত জয়শ্রীর
বল বীর –
আমি চির-উন্নত শির !

আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস ।
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বির
আমি দূর্বার
আমি ভেঙে করি সব চুরমার
আমি অনিয়ম উশৃঙ্খল
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল
আমি মানি না কো কোন আইন
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম, ভাসমান মাইন
আমি ধুর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল বীর –
চির-উন্নত মম শির !

আমি ঝণ্ঝা, আমি ঘূর্নি
আমি পথ-সমুখে যাহা পাই যাই চুর্নি
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল
আমি চল-চঞ্চল, ঠ’মকি ছ’মকি
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি
ফিং দিয়া দিই তিন দোল
আমি চপলা চপল হিন্দোল
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা
আমি উন্মাদ আমি ঝঞ্ঝা
আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর
আমি শাসন-ত্রাসন সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির !

আমি চির-দুরন্ত দূর্মদ
আমি দূর্দম, মম প্রানের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয় আমি শ্মশান
আমি অবসান, নিশাবসান
আমি ইন্দ্রানী-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ তুর্য

আমি কৃষ্ণ-কণ্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধির
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির !

আমি সন্ন্যাসী, সুর সৈনিক
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক
আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস
আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষানে ওঙ্কার
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার
আমি পিনাক-পাণির ডমুর শিত্রুল, যমরাজের দন্ড
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড
আমি ক্ষ্যাপা দূর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব
আমি প্রান খোলা হাসি উল্লাস, আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস
আমি মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহুগ্রাস
আমি কভূ প্রশান্ত, কভূ অশান্ত দারুন স্বেচ্ছাচারী
আমি অরুন খুনের তরুন, আমি বিধির দর্পহারী
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল
আমি উজ্জ্বল, আমি প্রজ্জ্বল
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল উর্মির হিন্দোল-দোল

আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি
আমি উন্মন মন উদাসীর
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাস আমি হুতাসীর

আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চিরগৃহহারা যত পথিকের
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুক্ষন
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন চুড়ির কন কন
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া
আমি পথিক কবির গভীর রাগিনী, বেণু বিনে গান গাওয়া
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি
আমি তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি, একি উন্মাদ আমি উন্মাদ
আমি সাহসা আমারে চিনেছি আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ

আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন
আমি বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে
তাজী বোর্রাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে

আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ
আমি ত্রাস সঞ্চারি ভূবনে সহসা সঞ্চারি ভুমকিম্প

ধরি বাসুকির ফণা জাপটি
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি
আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল
আমি ধৃষ্ঠ, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম
ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্ব নিঝ্ঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী
আমি রুষে উঠি যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল আখিল ব্যাপিয়া
আমি শ্রাবন-প্লাবন-বন্যা
কভূ ধরনীরে করি বরনীয়া, কভূ বিপুল ধ্বংস ধন্যা
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি

আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়
আমি মানব দানব দেবতার ভয়
বিশ্বের আমি চির দূর্জয়
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য
আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ

আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার
আমি হল বলরাম স্কন্ধে
আমি উপড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে

মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন
আমি স্রষ্টা-সুদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিব পদ-চিহ্ন

আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন আমি চির-বিদ্রোহী বীর–
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির !

কান্ডারী হুশিয়ার!-কাজী নজরুল ইসলাম

images

র্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!

দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার

গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!

কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।

ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!

বদলে যাও, কিছুটা বদলাও- আবুল হাসান

images-2

কিছুটা বদলাতে হবে বাঁশী
কিছুটা বদলাতে হবে সুর
সাতটি ছিদ্রের সূর্য; সময়ের গাঢ় অন্তঃপুর
কিছুটা বদলাতে হবে

মাটির কনুই , ভাঁজ
রক্তমাখা দুঃখের সমাজ কিছুটা বদলাতে হবে…

বদলে দাও, তুমি বদলাও
নইলে এক্ষুনি
ঢুকে পড়বে পাঁচজন বদমাশ খুনী ,
যখোন যেখানে পাবে
মেরে রেখে যাবে,
তোমার সংসার, বাঁশী, আঘাটার নাও ।
বদলে যাও, বদলে যাও, কিছুটা বদলাও !

ইতিহাস-আখতারুজ্জামান আজাদ

download

আমি কখনোই কারো প্রিয় হতে পারিনি —
না ঘরে, না বাইরে;
না বাইরে, না ভিতরে;
না ভিতরে, না ইতরে!

আমি কখনোই কারো প্রিয় হতে পারিনি —
না নরের, না নারীর;
না আত্মীয়ের, না আততায়ীর;
না আস্তিকের, না নাস্তিকের;
না কবির, না নবির।

আমার গলা নারীর বন্দনাগীত গায়নি,
জিভ থেকে পুরুষের স্তবক বেরোয়নি,
আমার হাত কারো পা ছোঁয়নি,
চোখ কারো ভণ্ডামো এড়ায়নি,
ঠোঁট ঢুকে পড়েনি অপঠোঁটে,
একনায়িকার খামখেয়ালে আমার শরীর করেনি ওঠবস,
আমার মগজ কাউকে দেয়নি পূর্ণ বা খণ্ডকালীন দাসখত!

আমার আত্মঘাতে ঘা খেয়ে উঠেছে পেশিবহুল পুরুষও,
আমার বিষবাক্যে চিত্‍কার করে উঠেছে পূজাপ্রত্যাশী নারীও!

ধুতি-টুপিতে টান পড়ায় শীত্‍কার করে উঠেছে ধর্মজীবী ধার্মিকও,
অজ্ঞাতনামা রোগে রাগান্বিত হয়ে উঠেছে নার্সিসাস নাস্তিকও!

অবশেষে,
আমি কখনোই কারো প্রিয় হতে পারিনি!

তোষামুদে-জন প্রিয় হয় সবার, এই হলো পরিহাস;
তোষামোদ করিনি কখনোই আমি, এই হলো ইতিহাস!

আমাকে ভালোবাসার পর——-হুমায়ুন আজাদ

images (29)
আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।

যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ’য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ’লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।

আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।

না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।

তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে পড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।

শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।

এখন যে কবিতা লিখবো আমি আবিদ আজাদ

এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
সেই কবিতাটি এক্ষুনি বাজেয়াপ্ত করা হবে
এক্ষুনি বেআইনি বলে ঘোষিত হবে সেই কবিতার
প্রতিটি শব্দ
প্রতিটি দাঁড়ি কমা
প্রতিটি সেমিকোলন
এক্ষুনি নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হবে সেই কবিতার প্রতিটি চরণ।
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার জন্যে মুহূর্তের মধ্যে সারাদেশ জুড়ে নেমে আসবে আরো
একটি উত্থানের প্রাক-মুহূর্তের স্তব্ধতা
নেমে আসবে রাইফেলের নলের মতো
মৃত্যু –
আর সেই মৃত্যুর স্তব্ধতায় বাংলাদেশেরআবহমান সবুজ রং
অন্ধকারের মতো কালো হতে হতে ভয়াল গর্জনে ফেটে পড়বে
সমুদ্রের মতো।
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার জন্যে হঠাৎ বোমাবাজির পর
ভরদুপুরের ভীষণ ভৌতিক গলির মতো শান্ত হয়ে যাবে
আমাদের প্রিয়তম এই রাজধানী
বাজতে থাকবে চারিদিকে বুটের আওয়াজ
শুধু বুটের
আওয়াজ
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার জন্যে নিমিষের মধ্যে সারা শহর জুড়ে শুরু হয়ে যাবে
খানাতল্লাশি
তার জন্যে আর্মি-ইন্টেলিজেন্স রুম থেকে বিমানবন্দরে ছড়িয়ে
দেওয়া হবে গোপন নির্দেশ
তার জন্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে বিমানেরসমস্ত নির্দিষ্ট ফ্লাইট
তার জন্যে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সারাদেশে জারি হয়ে যাবে
জরুরি অবস্থা –
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার জন্যে এক্ষুনি দিকে দিকে এসে যাবেচেকপোষ্ট
এক্ষুনি শাহবাগের মোড়ে
টিকাটুলির তেমাথায়
ফার্মগেটের সামনে থামিয়ে দেওয়া হবে
সমস্ত চলন্ত বাস, কোচ আর কোস্টার
লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে সমস্ত রিকশা ও ঠেলাগাড়ি
আর মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে খানাতল্লাশি
চেক করা হবে সারি সারি যাত্রীদের শরীর
চেক করা হবে মহিলার চামড়ার ব্যাগ
চেক করা হবে কিশোরের খেলনার বল
চেক করা হবে গাড়ির পাদানির নিচ থেকে কার্পেটের অতল অবধি
চেক করা হবে সাইকেলচারী যুবকের প্লাস্টিকের থলি
চেক করা হবে বেতার ভবনের গেটে ঘোষিকারকণ্ঠ
তরুণ কবির বুকপকেট,
বলপেনের দাগভরা আঙুলের ভাঁজ
কেরানীর খাতা
অধ্যাপকের উড়োচুল
কৃষকের কোঁচড়
শ্রমিকের চোখ
পোড়া গাঁর স্কুল
গঞ্জের ক্যানভাসারের গলা
হকারের বগল
গরু-পাইকারের খতি
বেশ্যাপাড়ার দাগী-খুনির লুঙ্গির গাঁট
সেন্ট্রাল জেলের সব সেল
রেশনকার্ডের পরতে পরতে
এমনকি মুদ্দাফরাশের জবানবন্দির ভেতরেও চলবে তল্লাশি
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার গতি রোধ করতে গিয়ে সীমান্ত পুলিশের হাতে
ধরা পড়বে কয়েক লক্ষ টাকার গুঁইসাপের চামড়া
তার গতি রোধ করতে গিয়ে সীমান্তরক্ষীর হাতে
আটকা পড়বে তিন জন চোরাচালানিসহ কয়েক লক্ষ টাকার
বিদেশী শাড়ি
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
তার জন্যে মুহূর্তের মধ্যে ছদ্মবেশে টহল দিতে শুরু করবে
পুলিশ ভ্যান
তার জন্যে তছনছ হয়ে যাবে ইউনিভার্সিটির হলগুলি
তার জন্যে প্রচন্ড সন্ধ্যাবেলা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের
টিভি রুমের ভিতর থেকে সন্দেহবশত ধরে নিয়ে যাবে
দুজন ছাত্রকে
তার জন্যে বস্তিতে বস্তিতে আগুনের মতো
লেলিয়ে দেওয়া হবে গুন্ডাপান্ডা –
এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
সেই কবিতাটি যখন পড়বে কোনো এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা
আমি জানি তার ব্যর্থ কাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে তখন অসমাপ্ত
মুক্তিযুদ্ধ ফেলবে দীর্ঘশ্বাস
সেই কবিতাটি যখন পড়বেন চশমার-কাচ-ফাটা গ্রামের কোনো
এক প্রৌঢ় স্কুল মাস্টার
আমি জানি তার শূন্য চোখের সামনে তখন ভেসে উঠবে
এক শীতের ভোরে শিমুলগাছের নিচে উদ্ধার-করা হঠাৎ
নিখোঁজ হয়ে-যাওয়া তার ছেলের লাশ –
সেই কবিতাটি যখন পড়বে কোনো এক কলেজ ছাত্রী
আমি জানি তখন তার মনে পড়বে প্রেমিকের উষ্ণ চুম্বনের ভিতরে
আবিস্কার করা
প্রথম পৃথিবী প্রদক্ষিণের আলোড়ন নয়
তার মনে পড়বে পলায়নপর এক যুবকের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের
কথা –
সেই কবিতাটি যখন পড়বেন কোনো চল্লিশোত্তীর্ণ মহিলা
আমি জানি তার বিগত দিনের পশমকাঁটায় তখন জেগে উঠবে আকণ্ঠ
পরিতাপ
সেই কবিতাটি যখন পড়বেন কোনো এক বজ্জাতঅধ্যাপক
আমি জানি তখন তার মনে পড়বে তার হওয়ার কথা ছিল পুলিশ
কিন্তু তিনি হয়ে গেছেন অধ্যাপক –
সেই কবিতাটি যখন পড়বেন কোনো এক পত্রিকার সম্পাদক
আমি জানি তখন ঘুমের মধ্যে তার মাথার ভিতর থেকে বেরিয়ে
আসবে একটি ছায়ামূর্তি
আর তার মনে পড়বে – তার হওয়ার কথা ছিল সওদাগরি
অফিসের অ্যাকাউন্টেন্ট
কিন্তু তিনি হয়ে গেছেন সম্পাদক
এখন যে কবিতাটি লিখব আমি
তার জন্যে দৈনিক পত্রিকাগুলোর নাইট শিফটের টেবিলে টেবিলে
গুঞ্জরিত হয়ে ফিরবে চাপা গুঞ্জন
তার জন্যে চাকরি যাবে তথ্য সচিবের
তার জন্যে আপন পদে ইস্তফা দিতে হবে তথ্যমন্ত্রীকে
এখন যে কবিতাটি লিখব আমি
তার জন্যে অপেক্ষা করছে
দুটো লোহার ঠান্ডা হাতকড়া
তার জন্যে অপেক্ষা করছে
একটি ঘাতক ছুরি
তার জন্যে অপেক্ষা করছে
ভাড়া করা গুন্ডাদের একটি কালো গাড়ি
তার জন্যে অপেক্ষা করছে
উচ্চাভিলাষী কয়েক জন জেনারেলের ষড়যন্ত্রের
একটি নির্মম নির্জন মধ্যরাত্রি –
এখন যে কবিতাটি লিখব আমি
তার জন্যে আমার সন্তানের জন্মের যন্ত্রণা মুখে নিয়ে
আমার প্রিয়তমা নারীর মতো
অপেক্ষা করছে আমার বাংলাদেশ।

রক্তের কাফনে মোড়া লাশ রুদ্র মোহাম্মাদ শহিদুল্লাহ

11350757_812538862176209_1657730800226775480_n

যে গান আমাকে কাঁদায়
যে তৃষ্ণার সুবিশাল রাত্রির গহন জলে
ভেসে ভেসে নিজেকে হারাই,
জেগে জেগে নিজেকে পোড়াই-
সেই তৃষ্ণা আর সেই গানের দিব্যি কেটে বলছি,
আমি আরো একবার অন্তত সমুদ্রে যাবো
আমি আরো একবার সেই সে মিছিলে যাবো।
অসহায় মানুষ হত্যার প্রতিবাদে
পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধের প্রতিবাদে
আমি আরো একবার ভাঙবো শোষকের আইন
আমি আরো একবার প্রতিরোধে ঘৃনায় বিক্ষোভে
মানুষের সমুদ্রে এনে দেবো প্রবল জলোচ্ছাস।
আমি জানি, আমি জানি এদেশে সমতা আসেনি
আমি জানি এদেশে কোনো কিষানের ঘরে শষ্য ওঠে না।
হে দীপ্র জনতা–
গুলিবিদ্ধ শ্রমিকের লাশ আমি প’ড়ে থাকতে দেখেছি পথে,
তার ঘামে ভেজা উষ্ণ দেহ, অনাহারে শীর্ন পেট
তীব্র প্রতিবাদের ভঙ্গিতে যেন বলছিল: আমি ক্ষুধার্ত
আমি ক্ষুধার্ত…
আমি ক্ষুধার্ত…
রক্তের কাফনে মোড়া তার দেহ ছুঁয়ে আজ জেগে ওঠে
শত শত শপথের হাত,
শত শত আলোর সৈনিক।

বন্ধুর জন্য বিজ্ঞাপন

images (29)

আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম যে আমার
পিতৃশোক ভাগ করে নেবে, নেবে
আমার ফুসফূস থেকে দুষিত বাতাস ;

বেড়ে গেলে শহরময় শীতের প্রকোপ
তার মুখ মনে হবে সবুজ চয়ের প্যাকেট, এখানে
ওখানে দেখা দিলে সংক্রামক রোগ,
ক্ষয়কাশ উইয়ে-খাওয়া কারেন্সি নোটের মতো আমার ফুসফুসটিকে
তীক্ষ্ণ দাঁতে ছিদ্র করে দিলে, সন্দেহজনকভাবে পুলিশ ঘুরলে
পিছে, ডবল ডেকার থেকে সে আমাকে
ফেলে দেবে কোমল ব্যান্ডেজ, সে আমাকে ফেলে দেবে
ট্রান্সপেরেন্ট পাদুর রুমাল, আমি যাবো পাথি হয়ে পুলিশ-স্কোয়াড
থেকে
জেনেভায় নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে, বলবো-
আমি প্রেমিকার পলাতক গুপ্তচর ;

সে এসে অন্ধকারে চতুর চেরের মতো
আমার পকেট থেকে নেবে সব স্তলপদ্মগুলি
বলবে কনের কাছে চুপিচুপি অসম্ভব বদমাশ সে,
-চল্‌ ঘুরে আসি রাতের শো থেকে
তারপর নিয়ে যাবে ক্রমাগত ভুল ঠিকানায়
তবু সেই ভীষণ বদমাশটা আমার সমস্ত ভুল ভাগ করে নেবে,
ওর সমস্ত পাপ লিখে যাবে আমার ডায়েরিতে
আমার পাপ হাতে নিয়ে ধর্মযাজকের মতো অহঙ্কারে ঢুকবে গির্জায়

আমি এই ঢাকা শহরের সর্বত্র, প্রেসক্লাবে, রেস্তরাঁয়, ঘোড়দৌড়ের
মাঠে এমন একজন বন্ধু খঁজে বেড়াই যাকে আমি
মৃত্যৃর প্রাক্কালে উইল করে যাবো এইসব অবৈধ সম্পত্তি, কুৎসা
আমার লাম্পট্য, পরিবর্তে সে আমার চিরদিন যোযাবে ঘুমের ওষুধ
আমার অপরাধের ছুরি রেখে দেবে তার বুকের তলায়, আমার
পিতার কাছে
চিঠি দেবে এই বলে-ওর কথা ভাববেন না, ও বড়ো ভালো ছেলে
নিয়মিত অফিস করে দশ টা পাঁচটা ; অথচ সে জানবে আমার
সব বদঅভ্যাস, স্বভাবের যাবতীয় দোষ
তবু সে যাবে আমার সাথে ক্যামেরায় ফিল্ম ভর্তি করে
নিয়ে আত্মহত্যাকারী এক যুবকের ছবি তুলে নিতে, অবশেষে
মফস্বল শহরগামী কোনো এক ট্রেন চড়ে নেমে যাবে
আমার সাথে ভুল ইস্টিশনে;

এখনে ওখানে সর্বত্র আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম
যে আমাকে নিয়ে যাবে সুন্দরবনে হরিণ শিকারে, হরণের শিং থেকে
তার স্বচ্ছ খুর থেকে খুঁটে নেবে দামী অংশগুলি যেন ও গাভীর
খুর থেকে বানাবে বোতাম, সে
আমাকে প্রতিদিন ধার দেবে লোভ, এখনে
সেখানে শহরের পরিচিত অঞ্চলগুলিতে আমি সেই করল সাঙাতটিকে
খুঁজি, আমি শুধু সারাজীবন একটি বন্ধুর জন্য প্রত্যহ বিজ্ঞাপন দিই
কিন্তু হায়, আমার ব্লাডগ্রুপের সাথে
কারো রক্ত মেলে না কখনো।